Saturday, November 22, 2025

মাদ্রাসায় দুর্নীতি ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার

Share

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার টিকিকাটা আ. ওহাব মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি নিয়োগবাণিজ্য করেছেন প্রায় ৩২ লাখ টাকা। মাদ্রাসা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। শুধু এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ, তা নয়—দেশের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৫০টি মাদ্রাসাপ্রধানের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর। দাখিল ও আলিম মাদ্রাসার দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। তবে তদন্তে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মাদ্রাসাপ্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও দুর্নীতি কমছে না।

টিকিকাটা আ. ওহাব মহিলা আলিম মাদ্রাসা

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আরবি প্রভাষক মো. আ. হালিম জানান, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদে তার ছেলে মো. ফয়সাল নিয়োগ পেয়েছেন। ছেলের নিয়োগ লাভের আশায় তিনি ২০২২ সালের এপ্রিলে অধ্যক্ষকে ৫ লাখ টাকা নগদ দিয়েছিলেন। এর আগে চার-পাঁচবার এই নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগপ্রাপ্ত আরিফুর রহমানের কাছ থেকে অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন এবং অবসরপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী মো. মান্নানের ছেলে মো. মহসিনকে নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ দিতে অধ্যক্ষ নিয়েছেন চার লাখ। এছাড়া ল্যাব সহকারী বা গবেষণাগার পদে নিয়োগ পাওয়া দ্বীপ কুমার মিত্রের কাছ থেকে নিয়েছেন ছয় লাখ। আর মো. আ. হালিম তার নিজের এমপিওভুক্তির জন্য অধ্যক্ষের সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জমা করেছেন দুই লাখ টাকা।

সহকারী মৌলভী মো. সিদ্দিকুর রহমান তদন্ত কমিটিকে জানান, তার ছেলে সিফাতুল্লাহ অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে আবেদন করলেও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। কারণ সে পরীক্ষার নোটিশই পায়নি।

অবসরপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী মো. মান্নানের অভিযোগ—তার ছেলে মো. মহসিনকে নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ দেওয়ার শর্তে অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন প্রথমে নেন দেড় লাখ টাকা। এক সপ্তাহ পর আরও পাঁচ লাখ টাকা নেন। ২০২৪ সালের ১ জুলাই তাকে আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরও কত টাকা দিতে হবে জানতে চাইলে সাবেক নৈশপ্রহরী মান্নান আর কথা বলতে পারেননি, কান্না করছিলেন।

ওই মাদ্রাসার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান কমিটিকে জানান, ২০১৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ছয় জনকে ২০২২ সালে এমপিওভুক্ত করার কথা বলে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। তিনি দাবি করেন, আরবি প্রভাষক মো. মনিরুজ্জামানের এনটিআরসিএ সার্টিফিকেট জাল, তাই তার কাছ থেকে অধ্যক্ষ নিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। যদিও মো. মনিরুজ্জামান আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন তদন্ত কমিটির কাছে।

শিক্ষক মিজানুর রহমান তদন্ত কমিটিকে আরও জানান, ওই নিয়োগের সময়ে মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের সই জাল করা হয়েছিল। তার স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার ল্যাব সহকারী বা গবেষণাগার পদে আবেদন করলেও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি, কারণ তিনি পরীক্ষার নোটিশ পাননি।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ অধ্যক্ষ মাওলানা বেলায়েত হোসেনের সই করা নৈশপ্রহরী, ল্যাব সহকারী/গবেষণাগার সহকারী পদে আবেদন করা পাঁচ জন প্রার্থীর একটি তালিকা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই পদে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় সাত জনের নাম রয়েছে। সেখানে একটি পদের বিপরীতে তিন জন অংশগ্রহণকারী দেখানোর জন্য নতুন করে যোগ করা হয়েছে। যা অফিস আদেশে উল্লেখ নেই।

অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনের পর গত ১৭ আগস্ট টিকিকাটা আ. ওহাব মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা বেলায়েত হোসেন, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, গবেষণাগার/ ল্যাব-সহকারী, নৈশপ্রহরীর বেতন-ভাতা সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘অভিযোগ আসলে সঠিক না। যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা বলা আছে তাদের জিজ্ঞাসা করেন। তদন্ত প্রতিবেদন একতরফা হয়েছে।’’

অর্থ লেনদেন নিয়ে তদন্তের সময় তদন্ত কর্মকর্তা আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ বলেছেন। এটা ইন্টেনশনালি করা হয়েছে।’’

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম অচল: ছয় মাদ্রাসাপ্রধানের এমপিও স্থগিত

মাদ্রাসা অধিদফতর জানায়, দেশের ৬৬৫টি মাদ্রাসায় প্রকল্পের আওতায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সচল রাখার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও বেশ কিছু মাদ্রাসা আজ অবধি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সচল করেনি। এসব মাদ্রাসার মধ্যে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাপ্রধানের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে।

অধিদফতরের অফিস আদেশে দেখা গেছে, গত ২৭ আগস্ট পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলাধীন শেখবাঁধা রেয়াজিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. সাইফুল ইসলামের এমপিও সাময়িক স্থগিত করে, কেন স্থায়ীভাবে কর্তন করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার রিংভং রাহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার মোহাম্মদ আবু হুরাইয়ারার এমপিও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

একইভাবে শেরপুর সদরের চাঁদের নগর এম আর দাখিল মাদ্রাসার সুপার কে এম জে মো. ওয়ালী উল্লাহ, ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া চান্দের বাজার বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. শামসুজ্জামান, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের জয়পুর জামিলাতুন উলুম দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. আব্দুল বাইছ, বরগুনার বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ বড় মোকামিয়া তাহেরিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার মো. নজরুল ইসলামের এমিপও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

আর্থিক দুর্নীতি

নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার নুনুজ কালিমিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে উপবৃত্তি পাওয়া ছাত্রদের বিপরীতে টিউশন ফি বাবদ সরকারি অর্থ তুলে আত্মসাৎ করা এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট তার এমপিও সাময়িক স্থগিত করা হয়।

কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার মিরদী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে গত ৩১ আগস্ট দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার সহজপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক (বাংলা) মো. হাতেম আলী বিধিবহির্ভূতভাবে অষ্টম গ্রেড গ্রহণ করেছেন। এ কারণে গত ২ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে তার এমপিও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

এছাড়া অনিয়মের অভিযোগে ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া বাজার বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. বোরহান উদ্দিন এবং সহকারী গ্রন্থাগারিক মোহাম্মদ আব্দুল মালেকের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে।

শিক্ষক হয়রানি

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার দাসনাইপাড়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তিনি শিক্ষক নাজমা আক্তারের বেতন-ভাতা বন্ধ রেখেছেন। শিক্ষক হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান-প্রধানের এমপিও সাময়িক স্থগিত করা হয় গত ২৮ আগস্ট।

আদালতের আদেশ অমান্য

লালমনিরহাট সদর উপজেলার নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. মোসলেম উদ্দিনের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার না করায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এমপিও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে গত ২৭ আগস্ট। আদালতের আদেশে অধ্যক্ষ মো. মোসলেম উদ্দিনের বরখাস্ত প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়েছিল মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর।

আরও অভিযোগ

বিগত কয়েক বছর ধরে এমপিও জালিয়াতি, আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এ কারণে অনেক মাদ্রাসার শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি কারও কারও এমপিও স্থায়ীভাবে বাতিলও করা হয়েছে। এরপরও মাদ্রাসায় অনিয়ম ও দুর্নীতি থামছে না।

মাদ্রাসা অধিদফতরের সূত্র জানায়, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—তিন মাসে অর্ধশতাধিক অভিযোগে দাখিল মাদ্রাসা, মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ি-প্রধানরাও।

ভুয়া সনদের কারণে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার শেখেরগাঁও জে ইউ ফাজিল মাদ্রাসার আরবি বিষয়ের প্রভাষক ছুলাইমান এবং আইসিটি বিষয়ের প্রভাষক শুভর এমপিও গত ২৭ জুলাই স্থায়ীভাবে কর্তন করা হয়েছে।

এছাড়া গত ২৭ জুলাই একদিনে আলাদা আদেশে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলাধীন সামাদ সওদা মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলাধীন বয়রাট মাজাইল ফাজিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান, শেরপুর জেলার নালিতাবড়ী উপজেলার কলসপাড় নঈমী দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান, রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মাজবাড়ী এস. এ আলিম মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান এবং বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন আল-হেলাল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধানের এমপিও সাময়িক স্থগিত করাসহ কেন স্থায়ীভাবে কর্তন করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমরা তো শিক্ষকদের শাস্তি দিতে চাই না। তাদের বারবার সচেতন করা হয়। কিন্তু কেউ যদি না শোনেন, তাহলে তো ব্যবস্থা নিতেই হবে। যারা দুর্নীতি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের লোকবল কম। তা দিয়েই ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’’

Read more

Local News